The British Raj in India: Decline of the Indigenous With The British Raj in India establishment of British political dominance in India, the way was paved for the expansion of England’s economic dominance in the country. The sole purpose of the company’s economic policy was to exploit India in various ways for the prosperity of the country. Their selfish colonial economy led to the ultimate defeat of India and the collapse of India’s traditional agro-based rural economy. On the other hand, the ancient cottage industries were also destroyed. This chapter analyzes how the traditional economic and industrial economy of India was harmed by the end of British economic imperialism.
ভারতে ব্রিটিশ রাজ(The British Raj in India):
ইংরেজদের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক প্রাধান্য বিস্তারের পথও প্রশস্ত হয়ে ওঠে। স্বদেশের সমৃদ্ধির জন্য ভারতকে নানাভাবে শােষণ করাই ছিল কোম্পানির অর্থনৈতিক নীতির একমাত্র উদ্দেশ্য। তাদের এই স্বার্থপর উপনিবেশিক অর্থনীতির ফলে ভারতের চরম সর্বনাশ দেখা যায় এবং ভারতের চিরাচরিত কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়ে। অন্যদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত কুটির শিল্পগুলিও ধ্বংস হয়। এই অধ্যায়ে ব্রিটিশ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের শােষণে ভারতীয় সনাতন কৃষি ও শিল্প অর্থনীতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তারই বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
[ ১ ] নতুন ভূমিরাজস্ব নীতি(New land revenue policy British Raj in India):
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা , বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করেছিল। কিন্তু বাংলা তথা ভারতের ভূমিরাজস্ব বিষয়ে কোম্পানির ইংরাজ কর্মচারীদের কোনাে অভিজ্ঞতা না থাকায় লর্ড ক্লাইভ প্রচলিত রাজস্ব ব্যবস্থা বহাল রেখে দু’জন নায়েব – দেওয়ানকে রাজস্ব আদায়ের ভার দিয়েছিলেন। এইসব নায়েব – দেওয়ানদের অত্যাচার ও শােষণের ফলে বাংলায় মন্বন্তর দেখা দেয়। এই ঘটনায় আতঙ্কিত কোম্পানি বুঝতে পারলাে যে , এতদিন যাবৎ অনুসৃত রাজস্বনীতির পরিবর্তন প্রয়ােজন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্বনীতির পরিবর্তনের চিন্তাধারার ফলশ্রুতি হল , ওয়ারেন হেস্টিংস ও লর্ড কর্ণওয়ালিস প্রবর্তিত রাজস্ব ব্যবস্থা।
ওয়ারেন হেস্টিংসের রাজস্বসংক্রান্ত পদক্ষেপ : ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথমেই দুই অত্যাচারী রাজস্ব সংগ্রহকারী নায়েব – দেওয়ান রেজা খাঁ ও সিতাব রায়কে বরখাস্ত করেন । ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে ( ১৭৭৩-১৭৮৫ খ্রিঃ ) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে প্রথম ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করে । এই সময়ে রাজস্ব ব্যবস্থা তত্ত্বাবধানের জন্য একটি বাের্ড অফ রেভিনিউ বা রাজস্ব পর্ষদ’গঠিত করার পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ের জন্য নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী । নিয়ােগ করা হয় , এঁরা কালেক্টর নামে পরিচিত ছিলেন।
( ১ ) পাঁচসালা বন্দোবস্ত : ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে রাজস্বের পরিমাণ স্থির করার জন্য এবং সর্বাধিক রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে জমিদারদের সঙ্গে নীলামের ভিত্তিতে পাঁচসাল । বন্দোবস্ত বা পাঁচ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় । কিন্তু পাঁচসালা বন্দোবস্তের ফলে সরকারি আয় ব্যবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং কৃষকদের ওপর অত্যাচার – আরও বৃদ্ধি পায় । এর ফলে ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে এই আইনটি পরিত্যক্ত হয়।
( ২ ) আমিনি কমিশন গঠন : ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার ভূমি বন্দোবস্ত ও ভূমিরাজস্ব সম্পর্কে বিস্তৃত অনুসন্ধানের জন্য আমিনি কমিশন গঠন করেন । কৃষি জমির উর্বরতা অনুসারে রাজস্ব নির্ধারণ ও তা আদায় করা এবং কৃষকদের উন্নতির জন্য নানান রকম ব্যবস্থা নেওয়াই ছিল আমিনি কমিশনের কাজ । এই কমিশনের রিপাের্টের ভিত্তিতে উৎপন্ন ফসলের বা অংশ খাজনা ধার্য করা হয় ।
( ৩ ) একলা বন্দোবস্ত : ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে থেকে পাঁচসালা বন্দোবস্তের পরিবর্তে একসালা বন্দোবস্ত চালু করা হয় । ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় কমিটি অফ রেভেনিউ গঠিত হয় । ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে এই কমিটি বাতিল করে ‘ বাের্ড অব রেভিনিউ গঠিত হয় ।
লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (The permanent settlement of Lord Cornwallis British Raj in India):
লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী ব্যবস্থার শর্তগুলাে ছিল :
( ১ ) এই প্রথা অনুসারে বাংলা , বিহার ও উড়িষ্যার জমিদার শ্রেণি বংশানুক্রমিকভাবে জমির মালিকানা ভােগ করবে ।
( ২ ) জমিদাররা আদায়ীকৃত রাজস্বের নয় – দশমাংশ ভাগ কোম্পানিকে জমা দেবেন ।
( ৩ ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে ।
( ৪ ) বছরের নির্দিষ্ট দিনের সূর্যাস্তের মধ্যে সরকারি রাজস্ব জমা দিতে না পারলে সেই জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হবে ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল (The result of a permanent settlement in The British Raj in India):
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফলগুলােকে সুফল ও কুফল এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায় , যেমন :
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফলগুলি ছিল :
( ১ ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানির স্থায়ী আয় সুনিশ্চিত হয়।
( ২ ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সংগ্রহ করা অর্থ থেকে কোম্পানি তার বাণিজ্যিক বিনিয়ােগের মূলধন সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় ।
( ৩ ) সামগ্রিকভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতে রাজকীয় অনুগ্রহপুষ্ট একটি নতুন অভিজাত জমিদার শ্রেণি গড়ে ওঠে , যারা সরকারের প্রধান সমর্থক ছিলেন ।
( ৪ ) কৃষির উন্নতি ঘটে , ফলে দেশে কৃষিযােগ্য আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ।
( ৫ ) জমি থেকে সরকারের আয় ক্রমশ বাড়তে থাকে ।
( ৬ ) স্থায়ীভাবে জমিদারি লাভ করার ফলে জমিদাররা নানান জনহিতকর সংস্কারমূলক কাজে মনােযােগী হন।চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এইসব সুফল লক্ষ করেই ঐতিহাসিক মার্শম্যান বলেছেন , “It was a bold , brave and wise measure “.
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল (The evils of a permanent settlement British Raj in India):
কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফলগুলাে ছিল আরও প্রকট , যেমন :
( ১ ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে একদিকে জমিদার রাজস্ব আদায়কারী ও মধ্যস্বত্ব ভাগীরা বিশেষ লাভবান হন , অন্যদিকে কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ।
( ২ ) চিরস্থায়ী ব্যবস্থার ফলে জমিদারি থেকে জমিদারদের আয় বৃদ্ধি পেলেও সরকারি আয় সেই অনুপাতে বাড়েনি ।
( ৩ ) এই ব্যবস্থার ফলে বিনা পরিশ্রমে অপর্যাপ্ত আয়ের অধিকারী হওয়ায় জমিদাররা প্রায়ই ‘ জমির প্রতি উদাসীন ‘ থেকে শহরের বিলাসব্যসনের মধ্যে জীবন কাটাতেন । এছাড়া তারা । নিজেদের ইচ্ছামতাে জমি বিক্রি করে দিতেন , ফলে প্রজাদের অবস্থা অসহায় হয়ে পড়ত ।
( ৪ ) তাছাড়া চিরস্থায়ী ব্যবস্থার অন্যতম কুফল হল “ পাটনি প্রথার উদ্ভব । কোনও কোনও জমিদার প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার জন্য নির্দিষ্ট মূল্যের পরিবর্তে জমিদারির অংশ ছােটো ছােটো ভাগে বিভক্ত করে দিতেন , একে “ পাটনি ” বা পত্তনী ব্যবস্থা বলা হত । পাটনি প্রথার ফলে জমির উৎপাদনের মান আরও হ্রাস পায় এবং নতুন ছােটো মালিকরা প্রজাদের উপর অত্যাচার করতে থাকেন ।
( ৫ ) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে উদ্ভূত অর্থনৈতিক শােষণ আর অত্যাচার এই দুই – এর চাপে কৃষকদের জীবনে হতাশা আর বঞ্চনা নেমে আসে । বাধ্য হয়েই তারা মাঝে মাঝে বিদ্রোহের পথে অগ্রসর হত । এইসব সমালােচনা সত্বেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত অনেকাংশে সাফল্য লাভ করে । রাজা রামমােহন রায় , মার্শম্যান ও রমেশচন্দ্র মজুমদার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তুকে স্বাগত জানান ।
রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত(Raitwari settlement British Raj in India):
উনিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ – পশ্চিম ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য সুদৃঢ় হওয়ার পর রায়ত বা প্রকৃত চাষির কাছ থেকে সরাসরি খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত । রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত অনুসারে কৃষক জমির স্বত্ব লাভ করে এবং নির্দিষ্ট রাজস্বের বিনিময়ে প্রতিটি কৃষকের সঙ্গে সাধারণত ত্রিশ বছরের মেয়াদে জমি বন্দোবস্ত করা হয় । ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে বােম্বাই প্রেসিডেন্সিতেও রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় ।
মহলওয়ারী বন্দোবস্ত :
১৮২২ খ্রিস্টাব্দের নিয়ম – বিধি ( Regulation of 1882 ) জারি করে গাঙ্গেয় উপত্যকায় , বিশেষভাবে উত্তরপ্রদেশ , মধ্যপ্রদেশ , দিল্লি এবং পাঞ্জাবের ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি কৃষকদের পরিবর্তে প্রতিটি গ্রামের জনগােষ্ঠীর সঙ্গে কোনও কোনও অঙ্কুলে যে রাজস্ব বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয় তা মহলওয়ারী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত ।
মহলওয়ারী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য ছিল :
( ১ ) সরকারের পক্ষ থেকে কোনও কৃষক বিশেষের সঙ্গে জমির বন্দোবস্ত না করে গ্রামীণ জনগােষ্ঠীর সঙ্গে তা করা হত ।
( ২ ) প্রতিটি গ্রামের রাজস্বের পরিমাণ মােট হিসাবে স্থির করা হত এবং তা গ্রামের কোনও এক দায়িত্বশীল ব্যক্তির মাধ্যমে আদায় করার ব্যবস্থা করা হত ।
( ৩ ) মহলওয়ারী বন্দোবস্তে প্রতি ৩০ বছর অন্তর জমির খাজনা পুনর্বিবেচনা করার সুযােগ রাখা হত । কিন্তু এই বন্দোবস্ত অনুসারে ব্যক্তিগতভাবে কৃষকদের ওপরে করের বােঝা বেড়ে যায় ।
ভাইয়াচারি রাজস্ব ব্যবস্থা :
মহলওয়ারী ব্যবস্থার পাশাপাশি , পাঞ্জাব অঞলে ভাইয়াচারি ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় । এই ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রতিটি গ্রামের কৃষক , জনপ্রতিনিধি এবং কালেক্টরের সঙ্গে যৌথভাবে আলাপ – আলােচনার মাধ্যমে যে খাজনা নির্ধারণ করা হত , তা ভাইয়াচারি ব্যবস্থা নামে পরিচিত । এই ব্যবস্থায় কয়েক বছর ছাড়া ছাড়া খাজনার পরিমাণ বৃদ্ধি করার নিয়ম ছিল ।
নতুন ভূমি রাজস্ব – ব্যবস্থার ফলাফল : ভারতের কৃষি অর্থনীতির ভাঙন ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা , বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি’অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা লাভ করেছিল । কিন্তু ভারত তথা বাংলার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে ইংরাজ কর্মচারীদের কোনাে অভিজ্ঞতা না থাকায় ‘ নায়েব – দেওয়ান ‘ নামে দু’জন উচ্চপদস্থ দেশীয় কর্মচারীর ওপর কোম্পানি প্রচলিত ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা অনুসারে রাজস্ব আদায়ের ভার দিয়েছিল । কিন্তু নায়েব – দেওয়ান নামধারী এইসব কর্মচারীদের অত্যাচার ও সীমাহীন শােষণের ফলে বাংলায় ‘ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখা দেয় । অবশ্য এইসব অত্যাচার ও শােষণের সঙ্গে কোম্পানির ইরাজ কর্মচারীরাও জড়িত ছিল । যাই হােক , এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে কোম্পানির বােধােদয় হল যে , এতদিন যাবৎ অনুসৃত রাজস্বনীতির আমূল পরিবর্তন করা প্রয়ােজন । কোম্পানির আমলের পাঁচসালা বন্দোবস্ত , একলা বন্দোবস্ত , চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত , রায়তওয়ারী বন্দোবস্ত , মহলওয়ারী বন্দোবস্ত প্রভৃতি বিভিন্ন রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল কোম্পানির এই পরিবর্তিত চিন্তাধারার ফসল।
প্রথমত , নতুন এইসব ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নানা পরিবর্তন আসে । ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ও সেই সঙ্গে নতুন প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় ভারতের পূর্বতন মধ্যস্বত্বভােগী শ্রেণির ( যেমন : জমিদার , কৃষক ও পঞ্চায়েত ) ক্ষমতা ও সুযােগসুবিধার বিনাশ ঘটে , ফলে ভারতের প্রাচীন গ্রামীণ সামাজিক সংগঠন ভেঙে পড়ে ।
দ্বিতীয়ত , নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থাগুলি কৃষকদের পক্ষে মােটেই লাভজনক হয়নি , কারণ এইসব ব্যবস্থায় জমি খরিদ – বিক্রি করার , বন্ধক দেওয়ার ও অন্যান্যভাবে হস্তান্তর করার ব্যবস্থা চালু হওয়ায় কৃষকদের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে ওঠে ।
তৃতীয়ত , নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ফলে এতকাল পর্যন্ত ভারতের গ্রামীণ জীবনে যে সামাজিক বন্ধন ছিল— —তা বিপর্যস্ত হয় । যৌথ পরিবার প্রথা ও পায়েত ব্যবস্থার ওপর চরম আঘাত আসে । গ্রামীণ জীবনে সহযােগিতার পরিবর্তে প্রতিযােগিতা আসে ।
চতুর্থত , নতুন ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার ফলস্বরূপ মহাজনদের কাছে দরিদ্র কৃষকদের জমি বন্ধক দেওয়ার রেওয়াজ ক্রমেই কৃষকদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা বিপর্যস্ত করে তােলে । প্রকৃতপক্ষে এইসব বন্দোবস্তের ফলে গ্রামীণ জীবনে কৃষকদের পরিবর্তে মহাজন , বণিক ও সরকারি কর্মচারীদের আধিপত্যের প্রতিষ্ঠা হয় এবং ভারতের গ্রামীণ জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যায় ।
ব্রিটিশ বাণিজ্য ধারার পরিবর্তন :
একচেটিয়া বাণিজ্যের সূচনা :
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে ভারতে একচেটিয়া ব্যাবসাবাণিজ্যের অধিকার লাভ করে ।ইংল্যান্ডের রাজপরিবার কােম্পানির পক্ষে থাকায় দীর্ঘদিন একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে কোম্পানির কোনাে অসুবিধা হয় নি । ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি বাংলা , বিহার , উড়িষ্যায় বিনা শব্দে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে । এরপর ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোম্পানির সর্বময় কর্তৃত্বপ্রতিষ্ঠিত হয় । কোম্পানির কর্মচারীরাও অবৈধভাবে সেই সুযােগসুবিধা গ্রহণ করে । তারা দন্তকের অপব্যবহার করে এবং নানান অবৈধ ও বেআইনী ব্যক্তিগত ব্যবসায় বিপুল পরিমাণ অর্থলাভ করে ।
অবাধ বাণিজ্য:
ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব ঘটার ফলে সেখানে শক্তিশালী ও সংগঠিত পুজিপতি শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে । তারা প্রাচ্যদেশে কোম্পানির একচেটিয়া কারবার রদ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে । অবশেষে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চ্যাটার অ্যাক্ট – এর মাধ্যমে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ পৃজিপতিদের অবাধ বাণিজ্যের অধিকার স্বীকৃত হয় । এর ফলে ইংল্যান্ডের কলকারখানায় তৈনি সন্তু দামের জিনিসপত্রে ভারতের বাজার ছেয়ে যায় । এইসব পণ্য দ্রব্যের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় ভারতীয় পণ্য ক্রমাগত পিছু হটতে থাকে , যার ফলে ভারতীয় শিল্প ক্রমশ ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যায় ।
দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়:
সপ্তদশ শতক থেকেই বস্ত্র ও রেশম শিল্পে বাংলা তথা ভারতবর্ষ ছিল পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও সমৃদ্ধশালী দেশ । ভারতীয় বস্ত্রশিল্প বিশেষত ঢাকার মসলিন , মিহি সুতিবস্ত্র , সুতা ও রেশম বস্ত্রের জগৎজোড়া চাহিদা ছিল । এছাড়া চিনি , লবণ , সােরা , কাগজ প্রভৃতি শিল্পেও বাংলা সমৃদ্ধ ছিল । বাংলা ছাড়াও সুরাট , আমেদাবাদ , ব্রোচ , ব্যাঙ্গালাের , আগ্রা , লক্ষ্মেী , বারাণসী প্রভৃতি খানও বয়নশিল্পের কেন্দ্র হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল । রবিনসন ক্রুসাে গ্রন্থের লেখক ভ্যানিয়ন ডেফো বলেছিলেন যে , ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে , বসবার ঘর ও শােবার ঘর সর্বত্রই ভারতীয় বস্ত্র ঢুকে পড়েছে ভারতীয় বাস্ত্রের এই চাহিদা ইংল্যান্ডের বস্ত্র প্রস্তুতকারকদের যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । ভারতীয় বস্ত্রের জনপ্রিয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে আইন তৈরি করা হয় । কিন্তু এইসব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগ পর্যন্ত বিদেশের বাজারে ভারতীয় সুতা ও রেশমবস্ত্রের চাহিদা অব্যাহত ছিল । ভারতে কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এদেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত এই কুটিরশিল্পের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং কালক্রমে তা ধ্বংস হয়ে যায় । ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসের কারণ হিসেবে রমেশচন্দ্র দত্ত , রজনীপাম দত্ত , নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ , বিপান চন্দ্র , অমিয় বাগচী প্রমুখ । ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন , যেমন :
[ ১ ] দাদন প্রথার কুফল : পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই কর্মচারী , দেশীয় এজেন্ট বা গােমস্তাদের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁতিদের দাদন বা অগ্রিম দিত । কোম্পানির দাদন গ্রহণ করায় তাঁতিরা অন্য কোথাও উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রি করতে পারতাে না এবং কম দামে লােকসান স্বীকার করেও তারা উৎপন্ন বস্তু কোম্পানিকে বিক্রি করতে বাধ্য থাকত ।
[২ ]কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য :
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা দন্তক ‘ – এর অপব্যবহার করে বাংলায় বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্য শুরু করে । এই অসাধু ব্যবসার ফলে এদেশীয় বণিকদের অবশ্য খারাপ হয়ে পড়ে । ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ানি লাভের পর থেকে কোম্পানি অন্যান্য ইউরােপীয় ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দিবে । বাংলায় নামাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে । বশিষ্ঠের ক্ষেত্রে কোম্পানির মূল নীতি ছিল সবপক্ষা রুম দামে মাল কিনে তা ইউরােপের বাজারে চড়া দামে বিক্রয় করা । পরিণামে ভারতীয় তাতিফের লাকসানের সীমা ছিল না ।
[৩] তুলার দাম বৃদ্ধি:
সুতিবস্ত্র তৈরির জন্য যে তুলার প্রয়ােজন হয় , কোম্পানির কর্মচারীরাই ত এতিনের চড়া দামে বিক্রয় করত । চড়া দামে তুলা কিনে এবং কম দামে বস্ত্র বিক্রি করে বা সৰস্বান্ত হয়ে পড়ত।
[৪]তাঁতিদের ওপর অত্যাচার
অনেক সময়কোম্পানির কুঠিল , পাইক ও বরকন্দাজরা তাতিদের ওপর জুলুম চালাত এবং কমদামে বেশি পরিমাণে কাপড় উৎপাদনে বাধ্য। এই স্থানে ভারতীয় তাতিদের প্রতি অত্যাচার ও অলিচা করে এবং সেই সঙ্গে তাদের পাপ থেকে নানাভাবে বস্থিত করে কোম্পানি ভারতের সুতি শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় তাতিদের ।
[৫]অবাধ বাণিজ্য :
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চ্যাটার অ্যাক্ট এর মাধ্যমে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার লােপ পেয়ে অবাধ বাণিজনীতি চালু হয় । বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোনও নিয়গুণ না থাকায় ইংল্যান্ডের বৃহদায়তন কলকারখানায় তৈরি সম্ভাদামের কাপড়ে ভারতের বাজার ছেয়ে যায় , ফলে ভারতীয় হস্তচালিত বস্ত্রশিল্প ক্রমশ পিছু হটতে থাকে । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের পর কিছু সময়ের জন্য ইউরােপের বাজারে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য প্রাধা বন্দ হয়ে যায় ।
[ ৬ ]শিল্পবিপ্লব:
ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটার ফলে যন্ত্রের সাহায্যে অতি অল্প সময়ের মধ্যে উন্নতমানের নানান দ্রব্যসামগ্রী উৎপন্ন হতে থাকে । ইংল্যান্ডের কলকারখানায় উৎপয়া প্রবা । সামগ্রীর সঙ্গে প্রতিযােগিতায় ভারতীয় শিল্প হেরে যায় । এই কারণেই ঐতিহাসিক রাব্রুক উইলিয়ামস , হ্যামিলটন প্রমুখরা বলেছেন যে , ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবই ছিল ভারতীয় শিল্প বাণিজোর ধ্বংসের মূল কারণ — এর জন্য ব্রিটিশ সরকার বিশেষ দায়ী ছিল না।
[৭]সরকারের অসম শুল্ক নীতি:
ইংল্যান্ডে জিনিসপত্র যাতে অবাধে ভারতে আসতে পারে তার জন্য কোম্পানি আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয় । অন্যদিকে , অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে ব্রিটেনে ভারত থেকে রপ্তানি করা পণ্যের ওপর উঁচু হারে শুল্ক ধার্য করা হয় । ব্রিটেনে ভাবলের রপ্তানি করা বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্কের হার ছিল অত্যন্ত বেশি । দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় যে ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনে ভারতীয় ছাপা সুতিবন্ত্র ও মসলিনের ওপর শুল্কের হার ছিল যথাক্রমে ৬৭.৫ % এবং ৩৭.৫ % শতাংশ । চিনির ওপর ধার্য করা হত উৎপাদন মূল্যের তিনগুণ বেশি।
[৮] দেশীয় নৃপতিদের পৃষ্ঠপােষকতার অভাব:
পলাশির যুদ্ধের পর ভারতের রাজা , জমিদার এবং তাদের কর্মচারী ও অভিজাতরা , যারা এতদিন পর্যন্ত ভারতীয় কুটিরশিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপােষক ছিলেন , তাদের ক্লম – অবলুপ্তি ভারতীয় কুটিরশিল্পের ওপর চরম আঘাত হানে । দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় যে , এতকাল ভারতীয় রাজাদের পৃষ্ঠপােষকতায় ভারতের কারখানাতেই সামরিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হত । কিন্তু ইংরেজ সরকার ভারতে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র কেনার বদলে তা ব্রিটেন থেকেআমদানি করার পক্ষপাতি ছিলেন । ফলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগরদের রুজিরােজগার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
[ ৯ ] শিল্প সংরক্ষণ নীতি :
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্ত , মহাদেব গােবিন্দ রাণাড়ে প্রমুখের মতে ভারতে যদি কোনাে জাতীয়তাবাদী সরকার ক্ষমতাসীন থাকতাে , তাহলে কখনই ভারতীয় শিল্পের অকালমৃত্যু ঘটত না । কিন্তু ভারতের বিদেশি সরকার ইংল্যান্ডের শিল্পপতিদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিত পথে ভারতের শিল্পকে ধ্বংস করে ফেলেছিল।
দেশীয় শিল্পের অবক্ষয়ের ফলাফল
ভারতের দেশীয় শিল্প ধ্বংস বা অবশিল্পায়নের সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল , যেমন :
( ১ ) বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের ফলে তাঁতিরা বেকার হয়ে যায় ।
( ২ ) বেশিরভাগ তাঁতি বেকার হয়ে যাওয়ায় তারা চাষবাসের কাজে লেগে পড়ে ।
( ৩ ) বস্ত্রশিল্পের ধ্বংসের ফলে ঢাকা , মালদা , পাটনা , রংপুর , বারাণসী , সুরাট , মুসুলিপট্টনম প্রভৃতি শহরগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে ।
( ৪ ) ক্রমশ ভারত একটি শিল্প রপ্তানিকারক দেশ থেকে শিল্প আমদানিকারক দেশে পরিণত হয় ।
আরও পডুনঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে